Offbeat Locations

All about My Tranquil Tours



চিঠি ১ : ঘুরে এলাম ধনৌলটি
০৯-০৪-২০১২


সময় গড়িয়ে চলেছে নিজের গতিতে, অবিরাম, অবিশ্রান্ত. ঘাত -প্রতিঘাত, সংগ্রাম-বিপর্যয়, প্রেম-ভালবাসা - কোনো কিছুই পারেনা তাকে মুহুর্তের জন্য থমকে দিতে. পারে না তার গতিকে স্লথ করতে. আর তাইতো আমাদেরও দৌড়াতে হয় তাল মিলিয়ে. প্রাপ্তি বা ক্ষতি, প্রেম বা ঈর্ষা, বন্ধুত্ব বা শঠতা, উন্নতি বা অধঃপতন - কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে আলসেমো করার সুযোগ নেই কারো. চরৈ বেতি, চরৈ বেতি. অক্লান্ত এই সফর; মৃত্যুর দোরগোড়া অব্দি নিজেকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব শুধু নিজেরই.

এই চলার পথে তাই আমি দুই হাতে কুড়িয়ে নিতে চাই সব ভালবাসা, ভালোলাগা, স্নেহ, বন্ধুত্ব আর নিবিরতা. কালকের দুঃখকে তুচ্ছ করে আজকের বর্তমানে খুঁজি শুধু আনন্দ. হৈ হৈ করে হেসে যদি কাটাতে পারি একটা দিন - সে তো আমার ই প্রাপ্তি! আর যদি তোমাদের দেওয়া দুঃখ বুকে জড়িয়ে কেদে ভাসাই,- স্বান্তনা দিতে কেউ আসবে না জানি. তাই তো আমি তুচ্ছ করেছি সব অন্ধকার অতীত. এমনকি আলোর অপেক্ষাতেও কাটাই নাই প্রহর; চকমকি ঠুকে নিজেই জ্বেলেছি আলো নিজের চারিপাশে. তোমরা দেখেছ শুধু সেই আলোর ঝলমলানি ঘিরে জীবনের উছ্বাস. দেখতে পাওনাই আলোর তলার আঁধার. তাই আমায় মন খুলে ভালবাসতে পারো; কারণ নিজেদের দেওয়া অন্ধকারকে যে তোমরা নিজেরাই ভয় পাও!

প্রতিদিনের এই উচ্ছ্বাসে জীবনী শক্তি বাড়ে বটে; তবে নয় মাসে ছয় মাসে - এক আধবার যে হাঁপিয়ে উঠি না, এমনটাও নয়. আমিও ক্লান্ত হই, আমার ক্ষমতাও জবাব দেয় মাঝে মাঝে. ভুল করে তখন আশা করে বসি তোমাদের কাছে একটু বেশী. ভাবি হয়ত তোমরা বুঝবে আমাকে. আঁকড়ে ধরে আগলে রাখবে ভালবাসার বন্ধনে. কিন্তু না! সে যে আমার ভ্রান্তি বিলাস. আমার নির্জীব মনটাকে কাছে টানার সাহস দেখায় না কেউ. তাইতো সেই দিনগুলোতে আমি হারিয়ে যেতে চাই একাকিত্বের অন্তরালে, প্রকৃতির নিবির আলিঙ্গনে. নির্মলতার স্পর্শে জেগে উঠি আবার নতুন করে প্রাণ চঞ্চল হয়ে.


এমনই এক একলা চল অভিযানে বেরিয়ে পরেছিলাম গত সপ্তাহে. না কর্মব্যস্ততার শ্রান্তিতে নয়, অবিরাম ঘাত-প্রতিঘাতের গ্লানিতে মন ছিল বিপর্যস্ত. সুদুর অতীতের ভুলে যাওয়া কিছু যন্ত্রণা যেন ফিরে আসছিল নতুন রূপে. তাই এই সব কিছু থেকে মুক্তি পেতে সাধের rucksack পিঠে ফেলে ঘুরে এলাম গাড়োয়াল হিমালয় - আমার ভীষণ পছন্দের মুক্তাঙ্গন. কোনো লম্বা সফর নয়, নয় সকাল থেকে রাত ঘুরে বেড়ানো; শুধুই বিশ্রাম- নিরবিছিন্ন. এই গাড়োয়ালের এক ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম - ধনৌলটি. মুসৌরী থেকে ৩০ কিলোমিটার, চম্বা (Uttarakhand) যাওয়ার পথে, পাহাড়ের খাঁজে আলগোছে শুয়ে থাকা এক শান্ত শিশুর মতো গ্রাম এই ধনৌলটি. স্নিগ্ধ, সুন্দর, সবুজে মোড়া এই জায়গা এক কোথায় অনবদ্য. এই শ্যামলীমা আর শুদ্ধতা সব তিক্ততা বদলে দেয় ভালবাসা আর স্নেহের আবেশে.


জায়গাটি নতুন নয় আমার কাছে. আগেও একবার এসেছিলাম. তবে এখন পর্যটক সমাগম বেড়েছে. দিনের বেলা তাই ভিড় বেশী. তখনকার সদ্য জন্মানো eco park এখন বেশ পরিনত. Adventure games এর ব্যবস্থাও হয়েছে সেখানে. দলে দলে লোক আসছে গাড়িতে চড়ে. Tourism এর বাসও আসতে শুরু করে দিয়েছে দেখলাম. মন একটু দমে গিয়েছিল এই ভিড় দেখে. তবে forest এর নতুন তৈরী bamboo cottage সব ভুলিয়ে দিল. বাস রাস্তা থেকে ধাপে ধাপে নেমে এসে সবুজ ঘাসে ঘেরা জমিতে ছবির মতো সাজানো গোটা ৪ ঘর. বাঁশের তৈরী. ডান হাতে বাঁশের canteen. আরো সোজা নেমে গেলে একটা community room. এইখানে আগে একটা দেবদারুর খোলে মেলা জঙ্গল ছিল. তার কিছুটা কেটে এই rest house তৈরী হয়েছে. সামনে এখনো বেশ কিছুটা খোলা জায়গা. তার মাঝে গুটি কয় দেবদারুর সমাবেশ. ইচ্ছে করে রয়ে যাই এখানেই কয়েক মাস.


সকাল ৯ তার কিছু পরেই সরকারী বাস পৌছে দিল ধনৌলটি,সবুজের কোলে, ভালবাসার আলিঙ্গনে. খোলা বাতাসে ভেসে গেল যাত্রার ক্লান্তি. এ যেন ভালবাসার পাঠশালার প্রবেশ দ্বার. একটা দিন যে কখন কি ভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারল না মন. পায়ে পায়ে চলা, টুকি টাকি কথা, দু চোখ ভরে দেখা- সব মিলে এক নির্মল উপভোগ. সব ব্যস্ততা থেমে গেছে প্রকৃতির গভীর নিরিব আলিঙ্গনে. সবুজ বনে হওয়ার মাতলামি, দূরের পাহাড়ে রোদের লুকোচুরি আর নানা রকম পাখির আলাপন - কেটে গেল সময় নিজের অজান্তে. দিন শেষে রাত এলো. বাড়লো ঠান্ডার দাপট. নিস্তব্ধ চরাচর. ভালোলাগার উষ্ণ আবেশ বুকে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পারি জমে ভালোবেসে. এমন শান্তির ঘুম আসে না কখনো ওই হট্টগোলের শহরে. এ যেন এক অচেনা স্তব্ধতার অন্তহীন গভীরতায় বেহিসাবী ভালবাসা.


চেনা অচেনা শব্দের মেদুরতায় হালকা সোনালী আভায় ভাসা সকাল. পাহাড়ি সকালের আমেজই আলাদা. এক এক পাহাড়ে এক-এক রকম ভোর হওয়া. তবে সব চাইতে প্রিয় হলো, নিঝুম প্রকৃতির মাঝে সদ্য জেগে ওঠা পাখিদের টুকরো টুকরো ডাক আর টিনের চলে ইতঃস্ততঃ চলে বেড়ানো. কারণ, এসব মিশে আছে আমার ছোট বেলায় গ্রামের বাড়ির ছুটির গল্পে. সুযোগ পেলেই আজ খুঁজে ফিরি সেই সুন্দর আনন্দঘন সকাল. ধনৌলটির ভোর ততটা সুন্দর না হলেও, মন্দ নয়. একটু একটু করে কালো থেকে আলোতে ভেসে যাওয়া দেখতে কার না ভালো লাগে! নানান রকম আলতো আওয়াজ, হাল্কা হওয়া আর আলোর খেলা - সব মিলে যেন কোনো রাজপ্রাসাদের জলসা শেষের একলা ঘরে জ্বলে থাকা ঝাড়বাতির আলাপ.


এমন সুন্দর জায়গায় ৫ দিন যেন বড়ই কম পড়ে যায়; মনে হয় কেন নয় আরো কিছু দিন, আরো কিছুটা একাকিত্ব ওই শহুরে হুল্লোড়ের থেকে! Eco park এর আলো আঁধারির জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে মন যে কোথায় হারিয়ে যায় কে জানে. কেন যে আগেকার গৃহ ত্যাগী মানুষগুলো হিমালয়ে পালাতো সে বেশ বোঝা যায় এই আদিমের গন্ধ মাখা প্রাচীনের কোলে বোসে. বুঝতে পারি কেন এত খরচা করে বিদেশীরা ছুটে আসে হিমালয় দেখতে. এমন মনোরম স্নিগ্ধতা সত্যি বিরল. সৌভাগ্য বশতঃ এক বিকেলে আকাশ কালো করে এলো মেঘ, সাথে ঝড়ো হওয়া. শুরুতে টুপটুপ, তারপর ধীরে ধীরে ঝমঝমিয়ে মুষলধারে. পাহাড়ে ঢালে এই বৃষ্টি দেখার মজাই আলাদা. হঠাত শুনি টিনের চালে ঠক ঠাক করে শব্দ হচ্ছে. দৌড়ে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি শিলা বৃষ্টি. ছোট ছোট গোল গোল সাদা নুড়িতে ভরে যাচ্ছে সব সবুজ. হওয়ার দাপটে দেবদারুর মাতলামি, চোখ বুজলে মনে হয় যেন কোনো বিশাল বড় জলপ্রপাতের বিপুল জলরাশি আছড়ে পরছে গভীর খাদের পাথুরে জমিতে. গুরু গম্ভীর সেই হওয়ার শব্দে চোখ বুজে কান পাতলে মন হারিয়ে যায় শান্তির অতল গহ্বরে. এলোমেলো হওয়ার দাপটে বাইরে থাকার সুযোগ জুটল না খুব একটা. তাই বাধ্য হয়ে গৃহবন্দী; শুধু দৃষ্টি হারিয়ে গেল কাঁচের জানালার বাঁধা পেরিয়ে পাহাড়ের মুক্তাঙ্গনে. দেখতে দেখতে ভরে গেল জমি টুকরো টুকরো সাদা শিলে. প্রায় ৪৫ মিনিট পরে দাপট কমল একটু. তবে বন্ধ হলো না বৃষ্টি. কম্বল গায়ে জড়িয়ে, আধো অন্ধকার ঘরে চুপ করে বিছানায় শুয়ে থাকার মজাই আলাদা. চোখ বুজে শুধু ভালোলাগা আর ভালবাসার আমেজ. সেই অনুভূতি ব্যক্ত করার ভাষা কোথায়? প্রায় ২ ঘন্টা পর বৃষ্টি থামল. বেড়ে গেল শীতের প্রকোপ. হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় নিঝুম ধনৌলটি. দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে অসময়েই. ফাঁকা হয়ে গেছে eco park. বৃষ্টি ভেজা সেই সন্ধ্যের কফির স্বাদ কি শুধু কফির ব্র্যান্ড দিয়ে বিচার করা যায়!



সব গ্লান্তি ক্লান্তি অভিমান ধুয়ে দিয়ে মুক্ত নির্মল মন. প্রকৃতিই পারে আমাদের সব অসহায়তা থেকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে. পারে আমাদের পুনর্জন্ম দিতে. তাইতো আমি ছুটে যাই বারবার এই হিমালয়ের কোলে. ভালবাসার সন্ধানে. যে ভালবাসা এনে দেয় জীবনী শক্তি, ফিরিয়ে দেয় কর্মোদ্যোগ. রোজকার এই যুযুধান বাঁচার এক ঘেঁয়েমি থেকে বেরিয়ে নতুন চোখে জীবনটাকে দেখা. ভালবাসার পরশ মেশা ছুটির কটা দিন, ভালোলাগার গভীরতায় চির অমলিন. "আবার আসিব ফিরে" - এই আশাতে ফিরে এলাম বৃষ্টি মাখা বিদায় নিয়ে. এই প্রথম বৃষ্টির মাঝেও সরকারী ঝড়ঝড়ে বাসে বসে বিরক্ত লাগলো না. মনে হলো না- ইশ! কি ঘিনঘিনে, অপরিস্কার! পাহাড়ের ঢাল আর আকাশের মেঘ দেখতে দেখতে কখন যে পৌছে গেলাম দেরাদূন বোঝাই গেলোনা প্রায়.


দরকারী তথ্য:

যাতায়াত: দেরাদুন অব্দি ট্রেনে গিয়ে তারপর বাস বা ট্যাক্সি. স্টেশনের লাগয়াই বাস স্ট্যান্ড. সকাল ৬ টার সরকারী বাস কিংবা যেকোনো সময় যেতে হলে প্রাইভেট ট্যাক্সি বা বাসে মুসৌরি অব্দি গিয়ে ওখান থেকে ভাড়ার ট্যাক্সি.ফেরা ওই বাসেই দুপুর ১.৩০ এর দিকে ধনৌলটি থেকে.
থাকার জায়গা: সরকারী গেস্ট হাউস আছে GMVN. আছে ফরেস্টের bamboo cottage. আছে আরো অনেক ছোট ছোট হোটেল.

No comments:

Post a Comment